অনলাইন ডেস্ক:
বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে শিক্ষাবিদ, অভিভাবক ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে অর্থ বরাদ্দ বাড়ানো হলেও প্রশ্ন রয়ে গেছে বাস্তবায়নের সক্ষমতা ও মানোন্নয়নের যথার্থতা নিয়ে।২০২৫–২৬ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৯৫,৬৪৪ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১২.০১ শতাংশ। তবে এটি দেশের মোট জিডিপির মাত্র ১.৭ শতাংশ, যেখানে ইউনেস্কো ৪–৬ শতাংশ বরাদ্দের সুপারিশ করে। এই অপ্রতুল অর্থায়নের কারণে কাঙ্ক্ষিত গুণগত উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
শিক্ষাব্যবস্থায় এখনও গুণগত মান অর্জনে বড় ঘাটতি রয়েছে। শহরের কিছু নামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া অধিকাংশ স্কুলে পাঠদান পদ্ধতি এখনো মুখস্থ নির্ভর। শিক্ষার্থীদের বিশ্লেষণমূলক ও সৃজনশীল ক্ষমতা তৈরির পরিবর্তে পরীক্ষাভিত্তিক মানদণ্ডই প্রাধান্য পাচ্ছে। দ্য ডেইলি স্টারের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও শিল্পক্ষেত্রের উপযোগী দক্ষ মানবসম্পদ গঠনে ব্যর্থ হচ্ছে।
শিক্ষক সংকট ও প্রশিক্ষণের অভাব দীর্ঘদিনের সমস্যা। অনেক স্কুলে নির্দিষ্ট বিষয়ের জন্য যোগ্য শিক্ষক নেই। নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী পাঠদান করতে হলে যেসব প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, তা অনেক ক্ষেত্রেই এখনো শিক্ষকদের দেওয়া হয়নি। ফলে পাঠ্যক্রম থাকলেও কার্যকর পাঠদান হচ্ছে না।
গত কয়েক বছরে ডিজিটাল শিক্ষার দিকে সরকারের নজর বাড়লেও শহর ও গ্রামাঞ্চলের মধ্যে এখনো ব্যাপক বৈষম্য বিদ্যমান। ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে স্মার্ট ক্লাসরুম, অনলাইন শিক্ষা ও প্রযুক্তিনির্ভর পাঠদান কিছুটা চালু হলেও অনেক গ্রামাঞ্চলে এখনো নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সুবিধার অভাব রয়েছে। শিক্ষার এই ডিজিটাল বিভাজন দীর্ঘমেয়াদে আরও বৈষম্য তৈরি করতে পারে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক চৌধুরি রফিকুল আব্রার বলেন, “আধুনিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষার বিকল্প নেই।” যদিও সরকার কারিগরি শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে, বাস্তবে এসব প্রকল্পের সুফল পৌঁছাচ্ছে না সবার কাছে। অনেক কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, ল্যাব ও দক্ষ শিক্ষক এখনও অনুপস্থিত।
সম্প্রতি সরকারি চাকরিজীবীদের আন্দোলনের কারণে অনেক বিদ্যালয়ে পাঠদান ব্যাহত হয়েছে। শিক্ষক সংগঠনগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি পালন চলছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীদের ওপর। শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও অস্থিরতা এখন অন্যতম প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শিক্ষাখাত নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞ ও গবেষকরা মনে করেন, কেবল বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো নয়, বরং সেই বাজেট বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব পূরণ করতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষক উন্নয়ন, গবেষণা কার্যক্রম, প্রযুক্তি ব্যবহার এবং শহর-গ্রামভিত্তিক বৈষম্য দূরীকরণের দিকেও নজর দিতে হবে।
শুধু শিক্ষার্থীকে বই আর পরীক্ষার চাপে ফেলে নয়, বরং বাস্তবজ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে একটি টেকসই, সমান ও মানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলেই বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের পথে সত্যিকার অর্থে এগোবে।